বইটির প্রাসঙ্গিক কথা থেকে নেয়া
এই পৃথিবীর প্রত্যেক জ্ঞানী ব্যক্তিই জানেন যে, ইমাম গাযযালী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন মাআরিফাত জগতের উজ্জ্বলতম জ্যোতির্ময় ভাস্কর। ইলমে জাহির ও বাতিন তত্ত্বের মহা জ্ঞানী ছিলেন তিনি। তাই তাঁকে “হুজ্জাতুল ইসলাম” (ইসলামের প্রমাণ) খেতাবে বিভূষিত করা হয়। শরীয়তের নিগূঢ় তথ্যের তত্ত্ব আবিষ্কারে তাঁর জুড়ি ছিল না। শরীয়ত, তরীকত, মাআরিফাত, হাকীকত ও ‘সুলুক’ তথা ইসলামী তাসাউফ বা সূফীতত্ত্ব ও তথ্যের বিভিন্ন পর্যায় যার শুরু শরীয়তের বাহ্যিক জ্ঞান থেকে এবং শেষ হাকীকাত বা রহস্য-জ্ঞান উঘাটনের স্তরে।
কাজেই শরীয়ত, তরীকত, মাআরিফাত ও হাকীকত এই বিষয় চতুষ্টয় একই বৃন্তের অন্তর্ভুক্ত। পরস্পর সাংঘর্ষিক নয়। শরীয়তের পথ অবলম্বনের পর মাআরিফাত (পরিচয়) অর্জনের উপায়-উপকরণকে তারীকত বলা হয়। এরূপ উপায়-উপকরণের দিক নির্দেশনায় যে জ্ঞান অর্জিত হয় তাই মাআরিফাত। মাআরিফাত তথা পরিচয় লাভের পর যে তাত্ত্বিক বাস্তবতার উন্মেষ ঘটে সেটাই হাকীকত। পানি একপ্রকার তরল পদার্থ। পানি তৃষ্ণা মিটায়। এতটুকু জ্ঞানকে যদি শরীয়ত ধরা যায়,
তাহলে পানি পান করার পদ্ধতিকে তারীকত বলা যাবে। পানি পান করার পদ্ধতির যথাযথ ব্যবহারের ফলে উদরের যে তৃষ্ণা জ্বালার অবসান হয়, তা হবে মাআরিফাত পর্যায় এবং এর পরে বা এর ফলে অন্তরে যে প্রশান্তি আসে—যাকে তৃপ্তি লাভ বলা হয়, তা হবে হাকীকাত। কাজেই বিষয়টি পরস্পর সম্পৃক্ত। ফলাফল পরস্পরাশ্রিত। এখানে বৈপরীত্যের ফিতনা আবিষ্কার করার অবকাশ নেই। হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম মুহাম্মদ গাযযালী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি শরীয়ত, তারীকত, মাআরিফাত ও হাকীকত বিষয় চতুষ্টয়ের তথ্য আবিষ্কারে অপূর্ব অবদান রেখেছেন। শরীয়ত মানব দেহের সঙ্গত ব্যবহারের পথ শিখিয়েছে। সুফীগণ বলে থাকেন । মান আরাফা নাফাসাহু ফাকা আরাফা রাব্বাহু অর্থাৎ নিজের প্রবৃত্তির পরিচয় পেলে সৃষ্টিকর্তা ও প্রতিপালকের পরিচয় লাভ হয়। সেমতে মাআরেফতের পথ অতিক্রম করার বাহন হলাে রূহ বা আত্মা। রূহের দ্বারা হাকীকাতের পরিচয়ের পথ অতিক্রম করতে হয় বলে রূহ সম্পর্কে কিঞ্চিৎ জ্ঞান থাকা আবশ্যক। সেজন্যে হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাযযালী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি আলােচনাধীন—‘হাকীকতে রূহ’— পুস্তিকা রচনা করেছেন। রূহ প্রসঙ্গে তাঁর তাত্ত্বিক আলােচনা তত্ত্ববহুল একটি অতি কঠিন আলােচনা। কুরআনে আল্লাহ তায়ালা নিজেই মানব-জ্ঞানকে রূহ তত্ত্ব জ্ঞাত হওয়ার জন্য অপর্যাপ্ত বলেছেন। উক্ত আয়াতে অবশ্য রূহ সম্পর্কে প্রশ্নকারী কাফিরদের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে ? “তারা তােমাকে রূহ সম্পর্কে প্রশ্ন করে। বলে দাও, পরমাত্মা (আর রূহ)। আমার প্রতিপালকের রহস্যময় বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত। আর তােমাদেরকে মাত্র। যৎকিঞ্চিৎ জ্ঞানই দেয়া হয়েছে। (১৭:৮৫) অর্থাৎ তােমাদের অপর্যাপ্ত জ্ঞান দ্বারা রূহের সম্যক জ্ঞান পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু কাফিরগণ। এমনকি ঈমানদারগণও রূহ জ্ঞান বঞ্চিত থাকবেন এমন বক্তব্য উক্ত। আয়াতে নেই। তাই, আল্লাহর অলিগণ রূহ তথা আত্মা সম্পর্কে নানা প্রসঙ্গে আলােকপাত করেছেন। আমাদের এই রচিত পুস্তিকাটিতেও ইমাম গাযযালী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি-এর রূহ সম্পর্কিত আলােচনাই স্থান লাভ করেছে।
রূহ কী এবং কেমন শিরােনাম সমৃদ্ধ আমাদের এই গ্রন্থটি সামগ্রিকভাবে একটি প্রাথমিক স্তরের গ্রন্থ হিসেবে গ্রহণ করাটাই সমীচীন হবে। রূহ সংক্রান্ত সকল কথা আমরা এতে আলােচনা করতে পারিনি। পরবর্তী পর্যায়ে আরাে কিছু বলার কামনাকে সামনে রেখেই কিছু কথার ইতি টানার প্রয়াস পাচ্ছি। তবে, জানা থাকা দরকার যে, ইলমে মারিফাতের গভীর সমুদ্রে সাতার কাটা সকলের পক্ষে সম্ভব নয়; বরং এ পর্যায়ে বিশেষ শ্রেণির লােকের দ্বারাই এই অসাধ্য সাধনের কাজ সমাধা হওয়া সম্ভব। ইমাম গাযযালী (রহঃ) ছিলেন সেই শ্রেণিরই একজন পথিকৃৎ। তাঁর হাকীকতে রূহ লেখনীই আমাদের এই পুস্তিকার মূল বিষয়বস্তু।